কোন কোন কারণে ওযু ভঙ্গ হয় ?

প্রশ্নঃ

আসসালামু আলাইকুম ! প্রিয় মুফতী সাহেব আমার প্রশ্ন হলো কোন কোন কারণে অযু ভঙ্গ হয়? দলিলসহ জানালে উপকৃত হতাম।

উত্তরঃ

وَعَلَيْكُمُ السَّلاَمْ وَ رَحْمَةُ اللّٰهِ وَ بَرَكَاتُهْ
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
حَامِدًا وَّمُصَلِّيََا وَّمُسَلِّمًا أمّٰا بَعَدْ

নামায সহীহ হওয়ার জন্য পূর্বশর্ত হলো অযু করা। আর অযু ছাড়া নামায হয় না। অযু সম্পন্ন করার পর কোন কোন কারণে অযু ভঙ্গ হয় তা জেনে রাখা অত্যন্ত জরুরী। কুরআন ও সহীহ হাদীসে অযু ভঙ্গের সাতটি কারণ রয়েছে। যার কোন একটি পাওয়া গেলে পুনরায় অযু করতে হবে। নিম্নে দলিলসহ অযু ভঙ্গের ঐ সাতটি কারণ বর্ণনা করা হলো।

১. পায়খানা বা পেশাবের রাস্তা দিয়ে পেশাব, পায়খানা, বীর্য, মযী, অদী,বায়ু, রক্ত, কৃমি, পাথর, পুঁজ প্রভৃতি কোন কিছু বের হলে অযু ভেঙ্গে যায়।

أَوْ جَاءَ أَحَدٌ مِّنكُم مِّنَ الْغَائِطِ

অর্থ: অথবা তোমাদের কেউ পেশাব-পায়খানা সেরে আসে (তাহলে নামায পড়তে পবিত্রতা অর্জন করে নাও) [সূরা মায়েদা আয়াত নং ৬]

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: الْوُضُوءُ مِمَّا خَرَجَ، وَلَيْسَ مِمَّا دَخَلَ

অর্থ: ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল ﷺ বলেছেন, শরীর থেকে যা কিছু বের হয় এ কারণে অযু ভেঙ্গে যায়। আর প্রবেশের দ্বারা ভঙ্গ হয় না। (সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী, হাদীস নং ৫৬৮)

তাহকীক: আইনী (রহ.) বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। ইবনে কাত্তান (রহ.) বলেন, এর সনদ হাসান কিংবা সহীহ। (নুখবুল আফকার ২/৬১ আল-ওয়াহমু ওয়াল ইবহাম ৫/৩২৪)

২. মুখ ভরে বমি হলে অযু ভেঙ্গে যায়।

عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَاءَ فَأَفْطَرَ فَتَوَضَّأَ . فَلَقِيتُ ثَوْبَانَ فِي مَسْجِدِ دِمَشْقَ فَذَكَرْتُ ذَلِكَ لَهُ فَقَالَ صَدَقَ أَنَا صَبَبْتُ لَهُ وَضُوءَهُ

অর্থ: আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত: একদা রাসূল (ﷺ) এর বমি হলো,তাই তিনি ইফতার করে অযু করলেন। দামিশকের মসজিদে সাওবান (রা.) এর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হলে তাঁর কাছে এ ঘটনা বললাম। তিনি বললেন, আবু দারদা (রা.) ঠিকই বলেছেন, এ সময় আমি রাসূল (ﷺ) এর অযুর পানি ঢেলে দিয়েছিলাম। (ইফা. সুনানে তিরমিযী হাদীস নং ৮৭ সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ২৩৭৩ হাদীসের মান: সহীহ)

عَنْ عَائِشَةَ، قَالَتْ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ ‏ “‏ مَنْ أَصَابَهُ قَىْءٌ أَوْ رُعَافٌ أَوْ قَلَسٌ أَوْ مَذْىٌ فَلْيَنْصَرِفْ فَلْيَتَوَضَّأْ ثُمَّ لْيَبْنِ عَلَى صَلاَتِهِ وَهُوَ فِي ذَلِكَ لاَ يَتَكَلَّمُ ‏”‏ ‏.‏

অর্থ: আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা.) বলেছেন, নামাযে কারো যদি বমি হয়, অথবা নাক থেকে রক্ত ঝড়ে অথবা মুখ দিয়ে খাদ্যদ্রব্য বেরিয়ে আসে অথবা মযী নির্গত হয়। তাহলে সে যেন ফিরে যায় এবং অযু করে। এরপর পূর্ববর্তী নামাযের উপর ভিত্তি করে নামায আদায় করে। আর এ সময় সে কোন কথা বলবে না। (ইফা. সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং ১২২১)

তাহকীক: যাইলায়ী (রহ.) বলেন, হাদীসটির সনদ সহীহ। (নাসবুর রায়াহ ১/৩৮)

৩. শরীরের কোন জায়গা হতে রক্ত পুঁজ বা পানি বের হয়ে গড়িয়ে পড়লে অযু ভেঙ্গে যায়।

قُلۡ لَّاۤ اَجِدُ فِیۡ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیَّ مُحَرَّمًا عَلٰی طَاعِمٍ یَّطۡعَمُہٗۤ اِلَّاۤ اَنۡ یَّکُوۡنَ مَیۡتَۃً اَوۡ دَمًا مَّسۡفُوۡحًا اَوۡ لَحۡمَ خِنۡزِیۡرٍ فَاِنَّہٗ رِجۡسٌ

অর্থ: আপনি বলে দিন, যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন আহারকারীর জন্যে,যা সে আহার করে। তবে যদি মৃত জন্তু কিংবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের গোশত হয়, তাহলে নিশ্চয় তা নাপাক। (সূরা আন’আম আয়াত নং ১৪৫)

ব্যাখ্যা: উপরোক্ত আয়াতে প্রবাহিত রক্তকে নাপাক বলা হয়েছে। উল্লেখ্য শরীর থেকে নাপাক বের হলে অযু ভেঙ্গে যায়। সুতরাং শরীরের কোন জায়গা হতে রক্ত প্রবাহিত হলেও অযু ভেঙ্গে যাবে।

عَنْ فَاطِمَةَ بِنْتِ أَبِي حُبَيْشٍ، أَنَّهَا كَانَتْ تُسْتَحَاضُ فَقَالَ لَهَا النَّبِيُّ صلى الله عليه وسلم ” إِذَا كَانَ دَمُ الْحَيْضَةِ فَإِنَّهُ دَمٌ أَسْوَدُ يُعْرَفُ فَإِذَا كَانَ ذَلِكَ فَأَمْسِكِي عَنِ الصَّلاَةِ فَإِذَا كَانَ الآخَرُ فَتَوَضَّئِي وَصَلِّي فَإِنَّمَا هُوَ عِرْقٌ

অর্থ: ফাতেমা বিনতে আবু হুবাইশ (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, তার ইস্তেহাযা হলে নবী (সা.) তাকে বললেন, হায়েযের রক্ত কালো বর্ণের হয়, তা দেখলে চেনা যায়। এমতবস্থায় তুমি নামায পড়া থেকে বিরত থাকবে। আর যখন অন্য রকম রক্ত হয় তখন অযু করে নামায আদায় করবে। কারণ তা একটি রগ থেকে নির্গত রক্ত। (ইফা. সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ২৮৬ সহীহ বুখারী হাদীস নং ২২৮ হাদীসের মান: সহীহ)

ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে রক্ত প্রবাহের কারণে অযুর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এতে স্পষ্ট বুঝা যায় রক্ত অযু ভঙ্গকারী।

عَنْ نَافِعٍ أَنَّ عَبْدَ اللَّهِ بْنَ عُمَرَ كَانَ إِذَا رَعَفَ انْصَرَفَ فَتَوَضَّأَ ثُمَّ رَجَعَ فَبَنَى وَلَمْ يَتَكَلَّمْ

অর্থ: নাফে (রহ.) থেকে বর্ণিত: যখন আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) এর নাক দিয়ে রক্ত বের হত, তখন তিনি নামায হতে ফিরে যেতেন। অতঃপর অযু করতেন এবং পুনরায় এসে অবশিষ্ট নামায আদায় করতেন, আর তিনি এই অবস্থায় কথা বলতেন না। (মুয়াত্তা ইমাম মালেক হাদীস নং ৭৬)

তাহকীক: শুয়াইব আরনাউত (রহ.) বলেন, এই হাদীসটির সনদ সহীহ। বায়হাকী (রহ.) বলেন, এর সনদ সহীহ। (তাখরীজু শারহিস সুন্নাহ ৩/২৭৮, সুনানে কুবরা লিলবায়হাকী ২/২৫৬)

৪. থুথুর সঙ্গে রক্তের ভাগ সমান বা বেশি হলে অযু ভঙ্গ হয়ে যায়।

قُلۡ لَّاۤ اَجِدُ فِیۡ مَاۤ اُوۡحِیَ اِلَیَّ مُحَرَّمًا عَلٰی طَاعِمٍ یَّطۡعَمُہٗۤ اِلَّاۤ اَنۡ یَّکُوۡنَ مَیۡتَۃً اَوۡ دَمًا مَّسۡفُوۡحًا اَوۡ لَحۡمَ خِنۡزِیۡرٍ فَاِنَّہٗ رِجۡسٌ

অর্থ: আপনি বলে দিন, যা কিছু বিধান ওহীর মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে, তন্মধ্যে আমি কোন হারাম খাদ্য পাই না কোন আহারকারীর জন্যে,যা সে আহার করে। তবে যদি মৃত জন্তু কিংবা প্রবাহিত রক্ত অথবা শূকরের গোশত হয়, তাহলে নিশ্চয় তা নাপাক। (সূরা আন’আম আয়াত নং ১৪৫)

ব্যাখ্যা: উপরোক্ত আয়াতে প্রবাহিত রক্তকে নাপাক বলা হয়েছে। উল্লেখ্য শরীর থেকে নাপাক বের হলে অযু ভেঙ্গে যায়। সুতরাং শরীরের কোন জায়গা হতে রক্ত প্রবাহিত হলেও অযু ভেঙ্গে যাবে।

৫. চিৎ বা কাত হয়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে গেলে অযু ভেঙ্গে যায়।

عَنْ عَلِيِّ بْنِ أَبِي طَالِبٍ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ قَال ‏” الْعَيْنُ وِكَاءُ السَّهِ فَمَنْ نَامَ فَلْيَتَوَضَّأْ ‏”‏ ‏.‏

অর্থ: আলী ইবন আবু তালেব (রা.) থেকে বর্ণিত।রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, চক্ষু নিতম্বের বন্ধন স্বরূপ। সুতরাং যে ব্যক্তি (চিৎ বা কাত হয়ে হেলান দিয়ে) ঘুমিয়ে যায়, সে যেন অযু করে। (ইফা. সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং ৪৭৭ হাদীসের মান: হাসান)

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: ” لَيْسَ عَلَى مَنْ نَامَ سَاجِدًا وُضُوءٌ، حَتَّى يَضْطَجِعَ، فَإِنَّهُ إِذَا اضْطَجَعَ، اسْتَرْخَتْ مَفَاصِلُهُ

অর্থ: ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত। রসূল (সা.) বলেছেন, সেজদা অবস্থায় ঘুমালে অযু ভঙ্গ হয় না, তবে চিৎ হয়ে শুয়ে পড়লে ভেঙ্গে যাবে, কেননা, চিৎ বা কাত হয়ে শুয়ে পড়লে শরীর ঢিলে হয়ে যায়। (মুসনাদে আহমাদ হাদীস নং ২৩১৫)

তাহকীক: বিশ্ব বিখ্যাত মুহাদ্দিস সুয়ূতী (রহ.) বলেন,হাদীসটির সনদ হাসান। (জামেউস সগীর ৭৬০৭)

৬.পাগল মাতাল বা অজ্ঞান হয়ে গেলে অযু ভেঙ্গে যায়।

یٰۤاَیُّہَا الَّذِیۡنَ اٰمَنُوۡا لَا تَقۡرَبُوا الصَّلٰوۃَ وَ اَنۡتُمۡ سُکٰرٰی حَتّٰی تَعۡلَمُوۡا مَا تَقُوۡلُوۡنَ

অর্থ: হে ঈমানদারগণ! তোমরা নেশাগ্রস্ত অবস্থায় নামাযের কাছেও যেওনা যতক্ষণ না তোমরা যা বলো তা বুঝতে পারো। ( সূরা নিসা আয়াত নং ৪৩)

عَنْ عَلِيٍّ، أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ ‏”‏ رُفِعَ الْقَلَمُ عَنْ ثَلاَثَةٍ عَنِ النَّائِمِ حَتَّى يَسْتَيْقِظَ وَعَنِ الصَّبِيِّ حَتَّى يَشِبَّ وَعَنِ الْمَعْتُوهِ حَتَّى يَعْقِلَ ‏

অর্থ: আলী (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তিন ব্যক্তির উপর থেকে দন্ডবিধি রহিত করে দেওয়া হয়েছে, ঘুমন্ত ব্যক্তি যতক্ষণ না সে জাগ্রত হয়, শিশু যতক্ষণ না সাবালক হয়, বেহুশ ব্যক্তি যতক্ষণ না তার হুশ ফিরে আসে। (ইফা. সুনানে তিরমিযী হাদীস নং ১৪২৮ সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ৪৩৪৭ হাদীসের মান: সহীহ)

যেহেতু নেশা করে মাতাল হয়ে গেলে অথবা পাগল বা অজ্ঞান হয়ে গেলে হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। ফলে বাতকর্ম হলেও বুঝতে পারবে না তাই এমন অবস্থা হলে অযু ভঙ্গ হয়ে গেছে ধরা হবে।

৭. নামাযে উচ্চস্বরে হাসলে অযু ভঙ্গ হয়ে যায়।

عَنْ أَبِي الْعَالِيَةِ الرِّيَاحِيِّ : ” أَنَّ أَعْمَى تَرَدَّى فِي بِئْرٍ وَالنَّبِيُّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – يُصَلِّي بِأَصْحَابِهِ ، فَضَحِكَ بَعْضُ مَنْ كَانَ يُصَلِّي مَعَ النَّبِيِّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فَأَمَرَ النَّبِيُّ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -مَنْ ضَحِكَ مِنْهُمْ أَنْ يُعِيدَ الْوُضُوءَ وَالصَّلَاةَ

অর্থ: আবুল আলিয়া আর-রিয়াহী (রহ.) থেকে বর্ণিত। এক অন্ধ লোক কূপের মধ্যে পড়ে গেল। তখন নবী (সা.) তাঁর সাহাবীদেরকে নিয়ে নামায পড়ছিলেন। যারা নবী (সা.) এর সাথে নামায পড়ছিল তাদের কতক লোক তাতে হেসে দিলো। তাদের মধ্যে যারা হেসেছিল তাদেরকে নবী (সা.) পুনরায় অযু করে নামায পড়ার নির্দেশ দিলেন। (সুনানে দারাকুতনী হাদীস নং ৫৮১)

তাহকীক: ইমাম যাহাবী (রহ.) বলেন, এই হাদীসটির সনদ সহীহ। (সিয়ারু আলামিন নুবালা ৪/২১২)

উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা আমরা জানতে পারলাম, কুরআন ও সহীহ হাদীসে অযু ভঙ্গের সাতটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবার অযু সম্পন্ন করার পরখেয়াল করা অযু ভঙ্গের উক্ত কোন কারণ পাওয়া যায় কিনা। কোন কারণ পাওয়া গেলেই অযু ভঙ্গ হয়ে যাবে এবং নতুন করে আবার অযু করতে হবে।

وَاللّٰهُ أعْلَمُ باِلصَّوَاب
উত্তর প্রদানে- হাসান রব্বানী।
শিক্ষার্থী: মানহাল ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার।
উত্তর নিরীক্ষণে: শাইখ রায়হান জামিল।
পরিচালক: মানহাল ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার।

Share This Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *