মাদানী নেসাব সমাচার জানা অজানা নানা তথ্য

সাধারণ মানুষ যারা কওমি সিলেবাস সম্পর্কে জানেন না, সন্তানকে কোন মাদ্রাসায় ভর্তি করাবেন সেই বিষয়ে চিন্তিত, তাদেরকে সচেতন করতে, যারা ভুল বুঝে মাদানী নেসাবের সমালোচনা করছেন তাদের সামনে সত্য প্রকাশ করতে আমার এই লেখা। এটা সমালোচনা নয় বরং আত্মসমালোচনা, কারণ সবাই আমরা ইসলামের জন্য নিবেদিত। লেখায় কোন সত্য কারো তিক্ত লাগলে তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। কোন কথা কারও অযৌক্তিক মনে হলে তার যৌক্তিক খণ্ডনকে স্বাগত জানাচ্ছি। এই লেখা বিভাজন সৃষ্টির জন্য নয়, বরং জনসচেতনতা সৃষ্টির জন্য, স্বল্প সময়ে ও শ্রমের বেশি এগিয়ে যাওয়ার পথ বাতলে দেয়ার জন্য। আল্লাহ সমস্ত অকল্যাণ থেকে আমাদেরকে হেফাজত করুন।

মাদানী নেসাব কী

বর্তমান কওমী মাদ্রাসায় দুইটি সিলেবাস প্রচলিত:

১। কদীম নেসাব: এটিতে শত বছর পূর্বে প্রণিত হওয়ার পর থেকে কোন সংস্কার হয়নি। এতে আরবি ভাষার চেয়ে উর্দু-ফার্সিকে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়। আগে এটি ১২ (তারও আগে আরো বেশি) বছর মেয়াদী হলেও মাদানী নেসাবের সংস্কারের ধাক্কায় এটির মেয়াদ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। তবে মাদানী নেসাবের মত অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলো বাদ না দিয়ে দুই বছরের কিতাব এক বছরে ঠেসে দেয়ায় লাভের পরিবর্তে সম্ভবত ক্ষতিই বেশি হচ্ছে।

২। মাদানী নেসাব: এটি যুগের প্রয়োজনে পরিবর্তনশীল, সমসাময়িক বিষয়গুলো এতে কিছু কিছু অন্তর্ভুক্ত। প্রায় ৩০ বছর আগে মাওলানা আবু তাহের মিসবাহ (আদীব হুজুর)-এর হাতে প্রণিত হয়েছে (প্রক্রিয়া এখনো চলমান)। তিনি তা তাঁর নিজস্ব প্রতিষ্ঠান মাদরাসাতুল মাদীনায় প্রয়োগ করেছেন। অবশ্য মাদানী নেসাব শুধু পাঠ্যসূচিতেই পরিবর্তন আনে নি, বরং পাঠদান পদ্ধতিতেও এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। এই পদ্ধতিগত পরিবর্তনগুলো না জানার কারণে অনেক প্রতিষ্ঠান মাদানী নেসাব খুলেও উপকৃত হচ্ছে না। এটি সাত বছর মেয়াদী।

কদীম নেসাবের সাথে মাদানী নেসাবের পার্থক্য:

উচ্চতর তিন বছর (জালালাইন থেকে দাওরা) পাঠদান পদ্ধতিগত পার্থক্য থাকলেও পাঠ্যসূচি “প্রায়” একই।১। শিক্ষার মেয়াদ বার বছরের পরিবর্তে সাত বছর২। ফারসি ভাষা বাতিল৩। উর্দুর চেয়ে আরবি ও বাংলার গুরুত্ব বৃদ্ধি৪। বিভিন্ন শাস্ত্রের প্রাথমিক কিতাবগুলো হলো উচ্চস্তরের কিতাবের জন্য সিঁড়ির ধাপ। উচ্চস্তরের কিতাবকে ঠিক রেখে এমন কিছু অপ্রয়োজনীয় ধাপ কমিয়ে দেয়া৫। ব্যাকরনের নিয়ম শেখানোর চেয়ে অনুশীলনকে গুরুত্ব প্রদান৬। মুখস্থ-বিদ্যার চেয়ে বুঝ-নির্ভরতাকে গুরুত্ব প্রদান৭। সম্মুখ-সমরের চেয়ে স্নায়ুযুদ্ধকে গুরুত্ব প্রদান৮। শিক্ষকের গাম্ভীর্য ও শাসনের চেয়ে “বড়ভাই-সুলভ” ব্যবহার ও উপদেশকে গুরুত্ব প্রদান৯। ছাত্রের সাথে শিক্ষকের সহাবস্থান, অর্থ্যাৎ একই মানের খাবার, ইত্যাদি। যাতে ছাত্রদের সুবিধা-অসুবিধা শিক্ষক বুঝতে পারেন১০। এক বছরেই আরবীতে কথা বলার যোগ্যতা অর্জন১১। এছাড়াও পাঠদান-পদ্ধতিগত অনেক পরিবর্তন আছে। যেমন সেমিস্টার পদ্ধতি, উর্দুমাধ্যমের পরিবর্তে বাংলা ও আরবীমাধ্যম, এমন আরো অনেক কিছু।

মাদানী নেসাবের সমালোচনা

অনেক প্রাচীন ধারার মানুষ মাদানী নেসাবের সমালোচনা করে। দরসের মসনদে বসে মাদানী নেসাবকে অকথ্য গালাগালি, ভর্তি পরীক্ষায় মাদানী নেসাবের ছাত্রদের প্রতি বৈষম্য- এগুলো যেন অধিকাংশ কদীম নেসাবের মাদ্রাসার রীতি হয়ে গেছে! সমালোচনার পয়েন্টগুলো তুলে ধরছি:

১। সমালোচকের অজ্ঞতা: অধিকাংশ সময় সমালোচনার জন্য এটিই দায়ী থাকে । সমালোচকরা মাদানী নেসাবে সিলেবাসভুক্ত কিতাবসমূহের তালিকা না জেনেই সমালোচনা করে বসে। إن بعض الظن إثم

২। কদীম নেসাবের চেয়ে কম মেয়াদী হওয়া : যেহেতু কদীম নেসাবের মেয়াদ বেশি হওয়া সত্বেও প্রচুর পড়ার চাপ থাকে, তাই মাদানী নেসাবের মেয়াদ কম হওয়া নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করে। কিন্তু তাতে যা বিয়োজন করা হয়েছে সেটা লক্ষ্য করে না। আর কম সময়ে বেশি এগিয়ে যাওয়া তো আরো প্রশংসনীয় বিষয়।

৩। মানতেক শাস্ত্র পড়ানো হয় না: এটি অপবাদ। মাদানী নেসাবে “মিরকাত” পড়ানো হয়। ঘটনা হলো, মানতেকের উচ্চতর কিছু কিতাব আগে কদীম নেসাবে ছিল। তখন মাদানী নেসাবে এগুলো বাদ দেয়ায় এই দুর্নামটা হয়েছে। কিন্তু পরবর্তীতে এগুলো বাদ দেয়ার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে কদীম নেসাবের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেও বাদ দেয়া হয়েছে। কিন্তু আগের সেই সমালোচনা রয়েই গেছে !

৪। আকাবিরদের প্রণোদিত সিলেবাসই শ্রেষ্ঠ: এটি নির্বুদ্ধিতামূলক কথা। আকাবিররা যুগের প্রয়োজনে সিলেবাস সংস্কার করাতেই তো তাদের সিলেবাস শ্রেষ্ঠ হয়েছিল। সুতরাং বর্তমান যুগের প্রয়োজনে যার সংস্কার হবে তা-ই শ্রেষ্ঠ হবে। যুগের পরিবর্তনে সব শাস্ত্রের প্রয়োজনীয়তা সমান থাকে না, যেমন ফারসি ভাষা একসময় আন্তর্জাতিকভাবে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ হলেও বর্তমানে তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে ইংরেজির গুরুত্ব বেড়েছে। এখন তা পরিবর্তন করাই সময়ের দাবি।

৫। আরবী ব্যাকরনে দুর্বলতা: ব্যাকরণের উচ্চতর কিতাব “শরহে জামী” ও “মুখতাসারুল মাআনি” বাদ দিয়ে অনুশীলনকে গুরুত্ব দেয়ায় আগে এমন অপবাদ ছিল। কিন্তু এখন ছাত্রদের আরবীতে দক্ষতা এতটাই প্রশিদ্ধ যে এসব অপবাদ বন্যায় ভেসে গেছে ! বরং কদীম নেসাবের ছাত্রদেরকে দেখা যায় রমজানে নাহু-সরফ কোর্স করতে, দাওরার পর “আদব বিভাগে” ভর্তি হতে ! (আদব বিভাগের সিলেবাস চেয়ে “আদীব”দেরকে লজ্জিত করবেন না !)

৬। দেওবন্দের সাথে অমিল: এমন কথা কেউ কেউ বললেও মজার ব্যাপার হলো দেওবন্দের সিলেবাস আট বছর মেয়াদী, সুতরাং কদীম নেসাবের চেয়ে তা মাদানী নেসাবের সাথেই অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ ! তাছাড়া দেওবন্দেও ফার্সি ঐচ্ছিক বিষয়, অথচ কদীম নেসাবে তা বাধ্যতামূলক !

৭। উর্দুতে দুর্বলতা: এই অভিযোগ সত্য। কদীম নেসাবের ছাত্রদের আরবীতে যেমন দুর্বলতা, মাদানী নেসাবের ছাত্রদের উর্দুতে তেমন দুর্বলতা। আবার কদীম নেসাবে উর্দুতে যেমন সাবলীলতা, মাদানী নেসাবে আরবীতে তেমন সাবলীলতা। এক্ষেত্রে আমার কাছে আরবীকে গুরুত্ব দেয়াই যৌক্তিক মনে হয়।

৮। কঠিন কিতাব পড়াতে পারে না: এই অপবাদ প্রমাণ করতে মাদানী নেসাবের “শেষ টেবিলের ছাত্র”দেরকে দিয়ে উদাহরণ দেয়া হয়। কিন্তু মাদানী নেসাবের ভালো ছাত্রের সাথে কদীম নেসাবের ভালো ছাত্র, মাদানী নেসাবের খারাপ ছাত্রের সাথে কদীম নেসাবের খারাপ ছাত্র,-এভাবে তুলনা করলে কেউ মাদানী নেসাবকে দুর্বল প্রমাণ করতে পারবে না। তবে জেনে রাখা প্রয়োজন যে নিসাব শুধু সহায়ক হয়, ছাত্রের প্রচেষ্টা ছাড়া কোনো নেসাবেই কাঙ্খিত ফল আসবে না।

৯। শুধু বাংলা কিতাব পড়ে আলেম হওয়া যায়না: এই কথা বলেও অনেকে মাদানী নেসাবের সমালোচনা করে। অথচ মাদানী নেসাবে যে আসলে আরবী কিতাবই বেশি সেটা সমালোচকরা জানে না। অনেক সময়ই কথা প্রসঙ্গে যখন আমি বলতাম যে এটা অমুক কিতাবে আছে, তখন অনেকেই অবাক হতো যে ওটাও মাদানী নেসাবে পড়ানো হয়। বরং কদীম নেসাবের ছাত্রদেরকে দেখা যায় আরবী কিতাব না বুঝে বাংলা ও উর্দু অনুবাদ দেখতে।

১০। মাদানী নেসাবের নাম বেঁচে খাওয়া কিছু বেহুদা প্রতিষ্ঠান: মাদানী নেসাবের পড়েনি, এবং নিসাবের পাঠদান-পদ্ধতি সম্পর্কে অজ্ঞ অনেকেই অসংখ্য মাদানী নেসাবের মাদ্রাসা খুলে বসেছে। এতো প্রতিষ্ঠানের কথা স্বয়ং মাদানী নেসাবের প্রতিষ্ঠাতা আদীব হুজুরেরও জানা নেই। এগুলো দেখে অনেকেই মাদানী নেসাবের প্রতি ভুল ধারণার শিকার হচ্ছে। এজন্য মাদানী নেসাবের শিক্ষক প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং বোর্ড গঠন করে কেন্দ্রীয় পরীক্ষা নেয়া খুবই জরুরী। যাদের সম্ভব এই বিষয়ে হুজুরকে অবহিত করা উচিত। (আদীব হুজুর এখনো এই বিষয়ে দৃষ্টি দিচ্ছেন না, এটা খুবই দুঃখজনক) আর অভিভাবকদের উচিত হল সন্তানকে এমন প্রতিষ্ঠানে দেয়া যেখানে মাদানী নেসাবের স্বনামধন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান (যেমন মাদরাসাতুল মাদীনাহ, বাইতুর রসুল হাজারীবাগ, মারকাযুল কুরআন উত্তরখান, বাইতুস সালাম, জামিয়াতুস সালাম উত্তরা, মাদরাসাতুল ইহসান উত্তরা, মারকাজুল ইলমী ওয়াদদাওয়াহ সাভার) -এ শিক্ষকতার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন শিক্ষক আছে। এবং “কদীম নেসাবের সাথে মাদানী নেসাবের সমন্বয়” – ইত্যাদি হাস্যকর স্লোগানদাতাদেরকে পরিত্যাগ করা। (মাদানী নেসাবের সিলেবাস অনুযায়ী শরহে বেকায়ার আগে বেফাক বোর্ড পরীক্ষা দেয়া অসম্ভব)

সিলেবাস সংস্কার অপ্রয়োজনীয় ভাবার আসল কারণ:

কদীম নেসাবে বহু বড় বড় ব্যক্তি থাকার পরও তার স্থবিরতার কারণ নিয়ে ভাবতে গিয়ে সেসব মাদ্রাসায় শিক্ষকদের বেতনের স্বল্পতা আমার কাছে প্রধান কারণ মনে হয়েছে । বেতন-স্বল্পতায় অধিকাংশ শিক্ষকই পারিবারিক দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে একাধিক চাকরির ব্যস্ততা মাথায় নিতে বাধ্য হন। একই সাথে মসজিদে ইমামতি, মাদ্রাসায় শিক্ষকতা, ব্যবসা, পারিবারিক দুশ্চিন্তা, ইত্যাদির পর শিক্ষার উন্নয়ন ও প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন নিয়ে ভাবার সুযোগ থাকে না।এ ব্যাপারে হাজারখানেক ছাত্র ও নিজস্ব জমিজমার মালিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পরিচালকদেরকে অনুরোধ করবো শিক্ষকদেরকে ভালো বেতন দিয়ে পারিবারিক দুশ্চিন্তামুক্ত ও শিক্ষার উন্নয়নে নিয়োজিত রাখতে। কমপক্ষে বিশ হাজার+ বেতন ছাড়া পরিবার চালানো বর্তমান যুগে খুবই দুরূহ। এই ধরনের বড় প্রতিষ্ঠানে গরিব কিনা তাহকীক করে “ফ্রী খানা” অনুমোদন করলে, সামর্থ্যবানদের থেকে সঠিকভাবে বেতন নিলে, অনায়াসেই শিক্ষকদের এই সমস্যা দূর করা সম্ভব। আল্লাহ সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন আমীন। সংগৃহীত ও সম্পাদিত

Share This Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *