ভয়ংকর ইয়াজুজ মাজুজের পরিচিতি!

কিয়ামত সংঘটিত হওয়ার আগে এই পৃথিবীতে বহু ভয়ংকর বিষয় প্রকাশিত হবে, তার একটি হলো, ইয়াজুজ মাজুজ জাতির প্রকাশ আর এই ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কেই আজকের এই প্রবন্ধ।ইয়াজুজ মাজুজ সম্পর্কে কুরআন ও সহীহ হাদীসের সুস্পষ্ট বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয় যে,ইয়াজুজ মাজুজ মানব সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত। পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন, وَجَعَلْنَا ذُرِّيَّتَهٗ هُمُ الْبَاقِيْن অর্থাৎ নুহের মহাপ্লাবনের পর দুনিয়াতে যত মানুষ আছে এবং থাকবে, তারা সবাই নূহ (আ.) এর সন্তান-সন্ততি হবে। ঐতিহাসিক বৰ্ণনা মতে হযরত নূহ (আ:) এর তিনজন ছেলে ছিল।

(ক) সাম: এর বংশধর সিরিয়া, জর্ডান, ইতালি আরব দেশ সমূহে বাস করে।(খ) হাম: এর বংশধর সুদান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, রাশিয়া এই দেশ সমূহে বাস করে।(গ) ইয়াফিস: এর বংশধর হলো তুর্কী, চীনা ও ইয়াজুজ মাজুজ। অর্থাৎ ইয়াজুজ মাজুজ হলো নূহ (আ:) এর পুত্র ইয়াফিসের বংশধর। (সূরা সফফাত আয়াত নং ৭৭, ফাতহুল কাদীর ও তাফসীরে জালালাইন)

ইয়াজুজ মাজুজ বর্তমানেও বিদ্যমান রয়েছে। আল্লাহ তা‘আলা পবিত্র কুরআনে বাদশা যুল-কারনাইনের ঘটনায় বলেন,“অবশেষে যখন তিনি দুই পর্বত প্রাচীরের মধ্যস্থলে পৌঁছলেন, তখন তিনি সেখানে এক জাতিকে পেলেন, যারা তাঁর কথা একেবারেই বুঝতে পারছিল না। তারা বলল, হে যুল-কারনাইন, ইয়াজুজ ও মাজুজ দেশে অশান্তি সৃষ্টি করছে। আপনি বললে আমরা আপনার জন্য কিছু কর ধার্য করব এ শর্তে যে, আপনি আমাদের ও তাদের মধ্যে একটি প্রচীর নির্মাণ করে দিবেন। তিনি বললেন, আমার রব আমাকে যে সামর্থ্য দিয়েছেন, তাই যথেষ্ট। অতএব, তোমরা আমাকে শ্রম দিয়ে সাহায্য কর। আমি তোমাদের ও তাদের মাঝে একটি সুদৃঢ় প্রাচীর নির্মাণ করে দিবো।

তোমরা আমাকে লোহার পাত এনে দাও। অবশেষে যখন পাহাড়ের মধ্যবর্তী ফাঁকা স্থান পূর্ণ হয়ে গেল, তখন তিনি বললেন, তোমরা হাঁপরে ফুঁক দিতে থাক। অবশেষে যখন তা আগুনে পরিণত হলো, তখন তিনি বললেন, তোমরা গলিত তামা নিয়ে আস। আমি তা এর উপর ঢেলে দেই। অতঃপর ইয়াজুজ ও মাজুজের দল তার উপরে আরোহণ করতে পারল না এবং তা ভেদ করতেও সক্ষম হলো না। যুলকারনাইন বললেন, এটা আমার রবের অনুগ্রহ। যখন আমার রবের প্রতিশ্রুত সময় আসবে, তখন তিনি একে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেবেন এবং আমার রবের প্রতিশ্রুতি সত্য।” (সূরা কাহাফ, আয়াত নং ৯৩-৯৮)

আবু সাঈদ খুদরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত নবী‎ (সা.) বলেন, মহান আল্লাহ ডাকবেন, হে আদম ! তখন তিনি জবাব দিবেন, আমি হাযির। তখন আল্লাহ বলবেন, জাহান্নামীদেরকে বের করে দাও। আদম (‘আঃ) বলবেন, জাহান্নামী কারা? আল্লাহ বলবেন, প্রতি হাজারে নয়শত নিরানব্বই জন। এ সময় ছোটরা বুড়ো হয়ে যাবে। প্রত্যেক গর্ভবতী তার গর্ভপাত করে ফেলবে। মানুষকে দেখাবে নেশাগ্রস্তের মত যদিও তারা নেশাগ্রস্ত নয়। বস্তুত আল্লাহর শাস্তি কঠিন (হাজ্জঃ ২)। সাহাবীগণ বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে সেই একজন কে? তিনি বললেন, তোমরা সুসংবাদ গ্রহন কর। কেননা তোমাদের মধ্যে হতে একজন আর এক হাজারের অবশিষ্ট ইয়াজুজ-মাজুজ হবে। (ইফা.সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১১১)

তাদের বিভিন্ন অবস্থা সম্পর্কে নাওয়াস ইবনে সামআন (রা.) এর হাদীসে বর্ণিত হয়েছে। সেখানে দাজ্জালের ঘটনা ও তার ধ্বংসের কথা বিস্তারিত বর্ণনার পর বলা হয়েছে, “এমতাবস্থায় আল্লাহ তা’আলা ঘোষণা করবেন, হে ঈসা! আমি আমার এমন বান্দাদের পাঠাবো যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ক্ষমতা কারো নেই। অতএব তুমি আমার বান্দাদের তূর পাহাড়ে সরিয়ে নাও। অতপর আল্লাহ তাআলা ইয়াজূজ-মাজূজের দল পাঠাবেন। আল্লাহ তাআলার বাণী অনুযায়ী তাদের অবস্থা হলো “তারা প্রতিটি উচ্চভূমি থেকে ছুটে আসবে” ( সূরা আম্বিয়া ৯৬)। এদের প্রথম দলটি (সিরিয়ার) তাবারিয়া উপসাগর অতিক্রমকালে এর সমস্ত পানি পান করে শেষ করে ফেলবে। অতপর তাদের পরবর্তী দল এখান দিয়ে অতিক্রমকালে বলবে, নিশ্চয় কোন কালে এতে পানি ছিলো।

আল্লাহর নবী ঈসা (আঃ) তাঁর সঙ্গীগণসহ অবরুদ্ধ হয়ে পড়বেন। তারা (খাদ্যের অভাবে) এমন এক কঠিন অবস্থায় পতিত হবেন যে, তখন একটি গরুর মাথা তাদের একজনের জন্য তোমাদের আজকের দিনের একশত স্বর্ণ মুদ্রার চেয়েও মূল্যবান (উত্তম) মনে হবে। তারপর আল্লাহর নবী ঈসা (আ.) এবং তাঁর সাথীগণ আল্লাহর দিকে রুজু হয়ে দুআ’ করবেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের (ইয়াজুজ মাজুজ বাহিনীর) ঘাড়ে মহামারীরূপে নাগাফ নামক কীটের সৃষ্টি করবেন। ভোরবেলা তারা এমনভাবে ধ্বংস হবে যেন একটি প্রাণের মৃত্যু হয়েছে। তখন আল্লাহর নবী ঈসা (আঃ) এবং তাঁর সাথীগণ (পাহাড় থেকে) নেমে আসবেন। তারা সেখানে এমন এক বিঘত জায়গাও পাবেন না, যেখানে সেগুলোর পচা দুর্গন্ধময় রক্ত-মাংস ছড়িয়ে নেই। তারা মহান আল্লাহর নিকট দুআ’ করবেন। তখন আল্লাহ তাআলা তাদের নিকট উটের ঘাড়ের ন্যায় লম্বা ঘাড় বিশিষ্ট এক প্রকার পাখি পাঠাবেন। সেই পাখিগুলো তাদের মৃতদেহগুলো তুলে নিয়ে আল্লাহর ইচ্ছামত স্থানে নিক্ষেপ করবে।

অতপর আল্লাহ তাআলা তাদের উপর এমন বৃষ্টি বর্ষণ করবেন যা সমস্ত ঘরবাড়ি ,স্থলভাগ ও কঠিন মাটির স্তরে গিয়ে পৌঁছবে এবং সমস্ত পৃথিবী ধুয়ে মুছে আয়নার মতো ঝকঝকে হয়ে উঠবে। অতপর যমীনকে বলা হবে, তোর ফল উৎপন্ন কর এবং তোর বরকত ফিরিয়ে দে। তখন অবস্থা এমন হবে যে, একদল লোকের আহারের জন্য একটি ডালিম যথেষ্ট হবে এবং একদল লোক এর খোসার ছায়াতলে আশ্রয় নিতে পারবে। আল্লাহ তাআলা দুধেও এতো বরকত দিবেন যে, একটি দুধেল উষ্ট্রীর দুধ একটি বৃহৎ দলের জন্য যথেষ্ট হবে। একটি গাভীর দুধ একটি গোত্রের লোকেদের জন্য যথেষ্ট হবে। একটি বকরীর দুধ একটি ক্ষুদ্র দলের জন্য যথেষ্ট হবে। তাদের এ অবস্থায় আচানক আল্লাহ তাআলা তাদের উপর দিয়ে মৃদুমন্দ বিশুদ্ধ বায়ু প্রবাহিত করবেন। এ বায়ু তাদের বগলের অভ্যন্তরভাগ স্পর্শ করে প্রত্যেক মুসলমানের জান কবয করবে। তখন অবশিষ্ট নর-নারী গাধার ন্যায় প্রকাশ্যে অপকর্মে লিপ্ত হবে। তাদের উপর কিয়ামত সংঘটিত হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস নং ৪০৭৫ হাদীসের মান: সহীহ)

আব্দুর রহমান ইবনে ইয়াযীদের বর্ণনায় ইয়াজুজ-মাজুজের কাহিনীর আরো কিছু বিবরণ পাওয়া যায়। তাতে রয়েছে, তাবরিয়া উপসাগর অতিক্রম করার পর ইয়াজুজ-মাজুজ বায়তুল মাকদিস সংলগ্ন পাহাড় জাবালুল-খমরে আরোহণ করে ঘোষণা করবে, আমরা পৃথিবীর সমস্ত অধিবাসীকে হত্যা করেছি। এখন আকাশের অধিবাসীদেরকে খতম করার পালা। সে মতে তারা আকাশের দিকে তীর নিক্ষেপ করবে। আল্লাহর আদেশে সে তীর রক্ত রঞ্জিত হয়ে তাদের কাছে ফিরে আসবে। (যাতে বোকারা এই ভেবে আনন্দিত হবে যে, আকাশের অধিবাসীরাও শেষ হয়ে গেছে )। (ইফা.সুনানে তিরমিযী হাদীস নং ৩১৫৩ হাদীসের মান: সহীহ)

যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাঃ) বর্ণিত একবার নবী‎ (সা.) ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থায় তাঁর নিকট আসলেন এবং বলতে লাগলেন, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আরবের লোকেদের জন্য সেই অনিষ্টের কারণে ধ্বংস অনিবার্য যা নিকটবর্তী হয়েছে। আজ ইয়াজুজ ও মাজুজের প্রাচীর এ পরিমাণ খুলে গেছে। এ কথা বলার সময় তিনি তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুলির আগ্র ভাগকে তার সঙ্গের শাহাদাত আঙ্গুলির অগ্রভাগের সঙ্গে মিলিয়ে গোলাকার করে ছিদ্রের পরিমাণ দেখান। যায়নাব বিনতে জাহাশ (রাঃ) বলেন, তখন আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের মধ্যে পুণ্যবান লোকজন থাকা সত্ত্বেও কি আমরা ধ্বংস হয়ে যাব? তিনি বলেন, হ্যাঁ যখন পাপকাজ অতি মাত্রায় বেড়ে যাবে। (ইফা.সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৩১০৯)

আবূ হুরাইরাহ্‌ (রাঃ) বর্ণিত তিনি বলেন, নবী (সা.) (ইয়াজূয-মাজূযের) প্রাচীর প্রসঙ্গে বলেন, এরা প্রত্যেকদিন বাঁধার প্রাচীর খনন করতে থাকে। যখন তারা এটাকে চৌচির করে ভেদ করার কাছাকাছি এসে যায়, তখন তাদের সরদার বলে, ফিরে চলো, কাল সকালে এটাকে সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে ফেলব। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, আল্লাহ তা‘আলা প্রাচীরটিকে পূর্বের ন্যায় পূর্ণাঙ্গ করে দেন। তারা প্রতিদিন এভাবে এই প্রাচীর খুঁড়তে থাকে। অবশেষে যখন তাদের বন্দীত্বের মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে এবং আল্লাহ তা‘আলা তাদেরকে জনবসতিতে পাঠানোর ইচ্ছা করবেন তখন ইয়াজূয-মাজূযদের সরদার বলবে, আজ চলো। ইনশাআল্লাহ আগামী কাল সকালে আমরা এই দেয়াল ভেঙ্গে ফেলব। সে তার কথার সাথে ‘ইনশাআল্লাহ’ বলে ফিরে যাবে। রাসূল সা. বলেন, তারা গতকাল দেয়ালটিকে তারা যে অবস্থায় ছেড়ে গিয়েছিল, এবার ফিরে এসে ঠিক সেই অবস্থায়ই পাবে। (আল্লাহর নাম ও তাঁর ইচ্ছার উপর নির্ভর করার কারণে সেদিন ওদের তাওফীক হয়ে যাবে) এবার দেয়াল ভেদ করে জনপদে ছড়িয়ে পড়বে। (ইফা.সুনানে তিরমিযী হাদীস নং ৩১৫৩ হাদীসের মান:সহীহ)

গবেষণা করে কেউ কেউ বলেন এই বিভক্তকারী প্রাচীরটি আর্মেনিয়া ও আজারবাইজান এর মাঝে দেওয়া আছে, বাস্তবতা আল্লাহ ভালো জানেন। আল্লাহ আমাদেরকে ইয়াজুজ মাজুজের ভয়ংকর ফেতনা থেকে হেফাজত করুন। আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।

Share This Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *