বাসর রাতের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়-সমূহ

বাসর রাতের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়-সমূহ

অনেক ভাই বাসর রাতের করণীয় ও বর্জনীয় বিষয়গুলো এবং ইসলামী শরীয়ত মতে স্ত্রীর সাথে কিভাবে সহবাস করতে হয় এটা জানতে চান তাদের জন্যই কুরআন হাদীসের আলোকে এই প্রবন্ধটি লেখা হয়েছে। কেননা ইসলামী যৌন বিজ্ঞান সম্পর্কে বর্তমান সমাজের অনেকেই অজ্ঞ! ফলে বহু মানুষ সঠিক মাত্রা ও ব্যবহার পদ্ধতি না জানার কারণে বিভিন্ন পাপ ও নানাবিধ যৌন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। যাই হোক এবার আসি মূল আলোচনায়। বাসর রাতে স্বামী প্রথমে রুমে প্রবেশ করে স্ত্রীকে সালাম করবে এর পর নতুন স্ত্রীর সাথে প্রথম সাক্ষাতের সময় তার কপালে হাত রেখে এ দু’আ পড়বে।

اَللّهُمَّ إنِّيْ أسْألُكَ مِنْ خَيْرِهَا وَخَيْرِ مَا جَبَلْتَ عَلَيْهِ . وأعُوْذ بِكَ مِنْ شَرِّهَا وَشَرِّ مَا جَبَلْتَ عَلَيْهِ

অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি আপনার নিকট এ স্ত্রীর কল্যাণ এবং যে কল্যাণের উপর তাকে সৃষ্টি করেছেন,তা প্রার্থনা করছি এবং স্ত্রীর অনিষ্টতা এবং যে অনিষ্টতার উপর তাকে সৃষ্টি করেছেন তা থেকে পানাহ চাচ্ছি। (সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং-২১৬০ ) এর পর স্বামী স্ত্রী পৃথক পৃথক হয়ে দুই রাকাত নফল নামায পড়ে আল্লাহর কাছে দুআ করবে।

আবদুল্লাহ ইবন মাসঊদ (রা) থেকে বর্ণিত,তিনি বলেন, রাসূল (সা.) বলেছেন, স্ত্রী যখন স্বামীর কাছে যাবে, স্বামী তখন দাঁড়িয়ে যাবে। আর স্ত্রীও দাঁড়িয়ে যাবে তার পেছনে। অতপর তারা একসঙ্গে দুই রাকা‌ত নামায আদায় করবে এবং বলবে اللَّهُمَّ بَارِكْ لِي فِي أَهْلِي، وَبَارِكْ لَهُمْ فِيَّ، اللَّهُمَّ ارْزُقْنِي مِنْهُمْ وَارْزُقْهُمْ مِنِّي، اللَّهُمَّ اجْمَعَ بَيْنَنَا مَا جَمَعْتَ إِلَى خَيْرٍ، وَفَرِّقْ بَيْنَنَا إِذَا فَرَّقْتَ إِلَى خَيْرٍ

‘হে আল্লাহ, আপনি আমার জন্য আমার পরিবারে বরকত দিন আর আমার ভেতরেও বরকত দিন পরিবারের জন্য। আয় আল্লাহ, আপনি তাদের থেকে আমাকে রিযিক দিন আর আমার থেকে তাদেরও রিযিক দিন। হে আল্লাহ, আপনি আমাদের যতদিন একত্রে রাখেন কল্যাণেই একত্র রাখুন আর আমাদের মাঝে যখন বিচ্ছেদ ঘটিয়ে দেবেন তখন কল্যাণের পথেই বিচ্ছেদ ঘটাবেন।’ (তাবরানী, মু’জামুল কাবীর হাদীস নং ৮৯০০)

অতপর স্বামী স্ত্রীর সাথে পরিচিত হবেন যদিও আগে থেকে পরিচয় জানা থাকে কারণ এতে করে দুই জনের মধ্যে মহব্বত সৃষ্টি হয়। অবশ্যই স্বামী স্ত্রীর মাসিক চলছে কিনা জিজ্ঞেস করে নিবে যদি মাসিক চলে তাহলে তার সাথে মিলিত হবে না কারণ মাসিক অবস্থায় সহবাস করা হারাম। কেননা, রাসূল (সা.) বলেছেন,যে ব্যাক্তি মাসিক অবস্থায় স্ত্রীর সাথে সহবাস করলো অথবা স্ত্রীর মলদ্বারে সঙ্গম করলো অথবা গণকের নিকট গেলো এবং সে যা বললো তা বিশ্বাস করলো, সে অবশ্যই মুহাম্মদ (সা.) এর উপর নাযিলকৃত জিনিসের (কুরআনের) বিরুদ্ধাচরণ করলো। (সুনানে তিরমিযী হাদীস নং ১৩৫)

এমনকি মাসিক অবস্থায় সহবাস করলে বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি হয়। তবে বর্তমানে মাসিক বন্ধ হওয়ার অষুধ বাজারে পাওয়া যায় কিন্তু এতে করে মেয়েদের ক্ষতি হয়ে থাকে তাই খুব জরুরী না হলে এমন না করাই উচিত। স্বামীর জন্য ঋতুবতী স্ত্রীর সঙ্গে যোনি ব্যবহার ছাড়া অন্য সব আচরণের অনুমতি রয়েছে। স্ত্রী পবিত্র হবার পর গোসল করলে তার সঙ্গে সব কিছুই বৈধ। কারণ, রাসূল (সা.) বলেছেন……ঋতুবতী স্ত্রীর সাথে সবই করতে পারবে কেবল সঙ্গম ছাড়া। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৭২০) সহবাসের পূর্বে এ দু‘আ পড়বে بِسْمِ اللّهِ اَللَّهُمَّ جَنِّبْنَا الشَّيْطَانَ وَجَنِّبِ الشَّيْطانَ مَا رَزَقْتَنَا.

অর্থঃ আল্লাহর নামের সাথে শুরু করছি। হে আল্লাহ! আপনি আমাদেরকে শয়তান হতে রক্ষা করুন এবং আপনি আমাদেরকে যে সন্তান দান করবেন তাকে শয়তান হতে রক্ষা করুন। (সহীহ বুখারী হাদীস নং-৫১৬৫)

স্বামী স্ত্রীর সাথে যে কোন ভাবেই সহবাস করতে পারে। মহান আল্লাহ বলেন “তোমাদের স্ত্রীগণ তোমাদের জন্য ক্ষেতস্বরূপ; অতএব তোমরা যেভাবেই ইচ্ছা তোমাদের ক্ষেতে গমণ কর”। (সূরা বাকারা আয়াত নং ২২৩)

এই আয়াতের তাফসীর হলো, শোয়া,দাঁড়ানো বসা ইত্যাদি অবস্থায়,সামনের দিক থেকে এবং পিছনের দিক থেকে যে কোন ভাবে (সহবাস করতে পারবে, তবে তা হতে হবে) স্ত্রীর যোনিপথে।’ ( দুররে মানছুর ১/২৬৫ তাফসীর তাবারী ২/৩৮৭-৩৮৮ মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ৪/২৩২)

তবে পায়খানার রাস্তা দিয়ে সহবাস করবে না কারণ এটা হারাম। কেননা, রাসূল (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর মলদ্বারে সঙ্গম করে, আল্লাহ্ তার দিকে (দয়ার দৃষ্টিতে) তাকান না। (ইবন মাজাহ হাদীস নং ১৯২৩)

আরেকটি বিষয় বর্তমানে সমাজে ঘটছে সেটা হলো পর্নো ভিডিও দেখে দেখে স্বামী স্ত্রী সহবাস করে থাকে অথচ এটা সম্পূর্ণ হারাম। আরেকটি বিষয় লক্ষ্যনিয় স্বামী স্ত্রী একজন আরেক জনের লজ্জাস্থান মুখের ভিতর দিবে না কারণ এটা পশু সূলভ আচরণ ও নোংরা রুচির পরিচায়ক এবং মুখের মধ্যে বীর্যপাত হওয়ার সম্ভবানা রয়েছে তাই এই কাজ থেকে বিরত থাকবে এমনটি করা মাকরুহে তাহরীমী। (ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া-২৯/১৪২)

বর্তমানে বাজারে দ্বীর্ঘক্ষণ সহবাস করার বিভিন্ন বড়ি বা সিরাপ পাওয়া যায়, এগুলো একদম ব্যবহার করবে না কারণ এতে করে পুরুষের পুরুষত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে, এমনকি গবেষণায় দেখা গেছে যারা এই কাজ করে তাদের শারীরিক অনেক ক্ষতিও হয়, তাই এগুলো থেকে বিরত থাকবে। তবে সহবাস করার আগে ইসুফ গুলের ভুসি, তুকমার দানা, দুধ, ডিম,ইত্যাদি খাওয়া যেতে পারে কারণ এতে অনেক উপকার আছে কিন্তু ক্ষতি নেই। স্ত্রীর সাথে প্রথম অবস্থায় সহবাসে লিপ্ত হবে না কারণ এতে করে স্ত্রীর আগেই স্বামীর বীর্যপাত হয়ে যায়, যা কিনা স্ত্রীর জন্য খুবই কষ্ট ও বিরক্তির কারণ। এই জন্যে প্রথমে স্ত্রীর ঠোটে, গলায়, মুখে চুম্বন করবে এবং স্তন মর্দন করবে তবে স্তন মুখে দিয়ে কখনো দুধ পান করবে না কারণ এটা মাকরূহ ও সন্তানের হক তবে স্তন চুম্বন করতে পারবে। কারণ রাসূল (সা.) তাঁর স্ত্রীর সঙ্গে আলিঙ্গন, চুম্বন ইত্যাদি করতেন। (যাদুল মা’আদ ৪/২৫৩)

স্ত্রীকে খুব দ্রুত উত্তেজিত করার জন্য লজ্জা স্থানে হাত বুলিয়ে দেয়া যেতে পারে এবং লজ্জা স্থান মুখে না দিয়ে আশপাশে চুম্বন করা যেতে পারে কারণ এতে করে নারীরা খুব দ্রুত উত্তেজিত হয়। এরপর যখন দেখবেন আপনার স্ত্রী খুব উত্তেজিত হয়েছেন তখন সহবাস শুরু করবেন এতে করে স্বামীর বীর্যপাত দেরিতে হবে এবং স্ত্রী খুব তৃপ্তি পাবে ফলে বৈবাহিক জীবন শান্তি ও সুখময় হবে।স্বামী-স্ত্রীর জন্য একে অপরের সমস্ত দেহের দিকে তাকানো, এমনকি যৌনাঙ্গের দিকেও তাকানো জায়েয, বাজারের কিছু চটি বইতে এবং কেউ কেউ বলে থাকে স্ত্রীর গোপনাঙ্গের দিকে তাকালে স্বামীর চোখের জ্যোতি কমে যায়, আসলে এ কথার কোনো ভিত্তি নেই। বরং হাদীস দ্বারা প্রমাণিত স্বামী স্ত্রীর সমস্ত দেহের দিকে তাকাতে পারবে। (সুনানে তিরমিযী হাদীস নং ২৭৯৪)

একাধিক বার সহবাস করতে চায়লে মাঝে একটু বিরতি দিয়ে নিজ নিজ লজ্জা স্থান পানি দিয়ে ধুয়ে নিবে প্রয়োজনে প্রস্রাব করে নিবে, এর পর অযু করে নেয়া মুস্তাহাব। রাসূল (সা.) বলেছেন,যখন তোমাদের কেউ নিজ স্ত্রীর সাথে সহবাস করার পর আবার সহবাস করতে চায় তখন সে যেন এর মাঝখানে ওযু করে নেয়। কেননা, এটি দ্বিতীয়বারের জন্য অধিক প্রশান্তিদায়ক। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৩০৮ হাকিম ১/২৫৪)

তবে গোসল করে নেয়া আরো উত্তম। কেননা রাসূল (সা.) বলেছেন, এরূপ করা অর্থাৎ গোসল করাই অধিকতর পবিত্রতা, উৎকৃষ্টতা ও পরিচ্ছন্নতার পরিচায়ক। ( সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ২১৯)

সহবাস শেষে স্বামী স্ত্রী দু জনেই ফরয গোসল আদায় করে নিবে কেননা রাসূল (সা.) বলেন, ‘তিন ব্যক্তির কাছে ফেরেশতা আসে না কাফের ব্যক্তির লাশ, জাফরান রং ব্যবহারকারী এবং অপবিত্র শরীর বিশিষ্ট ব্যক্তি। (সুনান আবু দাউদ হাদীস নং ৪১৭৬)

সহবাস শেষে ফরয গোসল আদায় করে নিলে বড় একটা উপকার হলো, ফজরের নামায কাযা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না তাই ফরয গোসল করে ঘুমানো উচিত। বাসর রাতের কথা কোন সময় বন্ধু বা নিকট আত্মীয়র কাছে গল্প করবে না কারণ এতে করে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হয় এবং নির্লজ্জতা প্রকাশ পায়,যা কিনা একজন ঈমানদার মুসলিমের শান বিরোধী। রাসূল( সা.) বলেন ‘কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে ওই ব্যক্তি সবচে নিকৃষ্ট বলে গণ্য হবে যে তার স্ত্রীর ঘনিষ্ঠ হয় এবং স্ত্রী তার ঘনিষ্ঠ হয় অতপর সে এর গোপন বিষয় প্রচার করে। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৩৬১৫)

আল্লাহ আমাদের সবাইকে উল্লেখিত সকল আদেশ নিষেধ মেনে চলার তাওফীক দান করুন আমীন ইয়া রব্বাল আলামীন।

Share This Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *