প্রশ্নঃ
আসসালামু আলাইকুম! একজন বললো সূরা ফাতিহা না পড়লে নাকি নামায হয় না। এখন আমি আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, ফরয নামাযে ইমামের পিছনে মুক্তাদীর সূরা ফাতিহা পড়তে হবে কি ?
উত্তরঃ
وَعَلَيْكُمُ السَّلاَمْ وَ رَحْمَةُ اللّٰهِ وَ بَرَكَاتُهْ
بِسْمِ اللّٰهِ الرَّحْمٰنِ الرَّحِيْمِ
حَامِدًا وَّمُصَلِّيََا وَّمُسَلِّمًا أمّٰا بَعَدْ
ইমামের পিছনে মুক্তাদীর কোনো কিরাতই পড়তে হবে না। কারণ ইমামের কিরাতই মুক্তাদীর কিরাত। ইমাম সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা মিলালে যেমন তা মুক্তাদীদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যায়। তেমনি সূরা ফাতিহা পড়লেও তা মুক্তাদীদের পক্ষ থেকে আদায় হয়ে যাবে। সুতরাং মুক্তাদীর আলাদাভাবে সূরা ফাতিহা পড়তে হবে না এবং অতিরিক্ত সূরাও মিলাতে হবে না। তবে একাকী নামায আদায়কালে প্রত্যেকের জন্য সূরা ফাতিহা এবং তার সাথে অতিরিক্ত কোনো সূরা মিলানো জরুরী।
وَاِذَا قُرِیٴَ الۡقُرۡاٰنُ فَاسۡتَمِعُوۡا لَہٗ وَاَنۡصِتُوۡا لَعَلَّکُمۡ تُرۡحَمُوۡنَ
১.অর্থ: আর যখন (ফরয নামাযে) কুরআন পড়া হয় তখন তোমরা মনোযোগ দিয়ে শোন এবং চুপ থাক, যাতে তোমাদের প্রতি অনুগ্ৰহ করা হয়। (সূরা আরাফ: আয়াত নং ২০৪)
ব্যাখ্যা: উক্ত আয়াতটি ফরয নামাযের ক্ষেত্রে নাযিল হয়েছে। অর্থাৎ ইমাম নামাযে যখন কিরাত পড়বে তখন মুক্তাদীদের দায়িত্ব হলো চুপ থাকা ও মনোযোগ সহকারে শোনা। এমতাবস্থায় কিরাত পড়া উক্ত আয়াতের স্পষ্ট বিরোধিতা হবে। অধিকাংশ মুফাসসিরে কুরআন এ মতই পোষণ করেছেন। (তাফসীরে ইবনে কাসীর ৩/৫৩৭ তাফসীরে তাবারী ১৩/৩৪৬)
عَنْ جَابِرٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم
مَنْ كَانَ لَهُ إِمَامٌ فَإِنَّ قِرَاءَةَ الإِمَامِ لَهُ قِرَاءَةٌ .
২.অর্থ: জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ্ (ﷺ) বলেছেন, যার ইমাম থাকবে, ইমামের কিরাতই তার কিরাত। (অর্থাৎ মুক্তাদীর পক্ষ থেকে ইমামের কিরাতই তার কিরাত বলে গণ্য হবে। (সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং ৮৫০ হাদীসের মান: হাসান)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” إِنَّمَا الإِمَامُ لِيُؤْتَمَّ بِهِ فَإِذَا كَبَّرَ فَكَبِّرُوا وَإِذَا قَرَأَ فَأَنْصِتُوا
৩.অর্থ: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, ইমাম তো এজন্য যে, তার অনুসরণ করা হবে। অতএব, যখন ইমাম তাকবীর বলে তখন তোমরাও তাকবীর বলো। আর যখন ইমাম কুরআন পড়ে তখন তোমরা চুপ থাকো। (সুনানে নাসাঈ হাদীস নং ৯২২ হাদীসের মান: হাসান)
عَنْ عَطَاءِ بْنِ يَسَارٍ، أَنَّهُ أَخْبَرَهُ أَنَّهُ، سَأَلَ زَيْدَ بْنَ ثَابِتٍ عَنِ الْقِرَاءَةِ، مَعَ الإِمَامِ فَقَالَ لاَ قِرَاءَةَ مَعَ الإِمَامِ فِي شَىْءٍ
৪.অর্থ: আতা ইবনে ইয়াসার (রহ.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, তিনি যায়েদ ইবনে সাবিত (রা.) কে ইমামের সাথে কিরাত পাঠ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। তিনি বললেন, ইমামের সাথে কোনো কিরাত নেই। (সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৫৭৭ হাদীসের মান: সহীহ)
جَابِرَ بْنَ عَبْدِ اللَّهِ، يَقُولُ مَنْ صَلَّى رَكْعَةً لَمْ يَقْرَأْ فِيهَا بِأُمِّ الْقُرْآنِ فَلَمْ يُصَلِّ إِلاَّ أَنْ يَكُونَ وَرَاءَ الإِمَامِ . قَالَ أَبُو عِيسَى هَذَا حَدِيثٌ حَسَنٌ صَحِيحٌ
৫.অর্থ: জাবের ইবনে আব্দুল্লাহ (রা.) থেকে বর্ণনা করেন যে, তিনি বলেন, কেউ যদি নামাযে উম্মুল কুরআন (সূরা ফাতিহা) না পড়ে, তাহলে তার নামায হবে না। কিন্তু ইমামের পিছনে হলে ভিন্ন কথা। (সেক্ষেত্রে ফাতিহা পাঠের দরকার নাই)। (সুনানে তিরমিযী হাদীস নং ৩১৩ হাদীসের মান: সহীহ)
عَنْ أَبِي الدَّرْدَاءِ، سَمِعَهُ يَقُولُ سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم أَفِي كُلِّ صَلاَةٍ قِرَاءَةٌ قَالَ ” نَعَمْ ” . قَالَ رَجُلٌ مِنَ الأَنْصَارِ وَجَبَتْ هَذِهِ . فَالْتَفَتَ إِلَىَّ وَكُنْتُ أَقْرَبَ الْقَوْمِ مِنْهُ فَقَالَ مَا أَرَى الإِمَامَ إِذَا أَمَّ الْقَوْمَ إِلاَّ قَدْ كَفَاهُمْ
৬.অর্থ: আবু দারদা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) কে প্রশ্ন করা হলো, প্রত্যেক নামাযে কি কিরাত আছে? তিনি বললেন, হ্যাঁ। এক আনসার ব্যক্তি বলল তা ওয়াজিব। তখন তিনি আমার দিকে লক্ষ করলেন, আমি সকলের মধ্যে তাঁর নিকটবর্তী ছিলাম। তিনি বললেন, ইমাম যখন দলের ইমামতি করেন, তখন আমি মনে করি, ইমামই তাদের জন্য যথেষ্ট। (সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং ৯২৩ হাদীসের মান: সহীহ)
عَنْ عِمْرَانَ بْنِ حُصَيْنٍ، قَالَ صَلَّى بِنَا رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم صَلاَةَ الظُّهْرِ – أَوِ الْعَصْرِ – فَقَالَ ” أَيُّكُمْ قَرَأَ خَلْفِي بِسَبِّحِ اسْمَ رَبِّكَ الأَعْلَى ” . فَقَالَ رَجُلٌ أَنَا وَلَمْ أُرِدْ بِهَا إِلاَّ الْخَيْرَ . قَالَ ” قَدْ عَلِمْتُ أَنَّ بَعْضَكُمْ خَالَجَنِيهَا ”
৭.অর্থ: ইমরান ইবনে হুসাইন (রা.) থেকে বর্ণিত যে, তিনি বলেন, রাসুলাল্লাহ (ﷺ) (একবার) আমাদের কে নিয়ে যোহর অথবা আসরের নামায আদায় করলেন। (নামায শেষে) তিনি বললেন, তোমাদের কে আমার পেছনে সাব্বি হিসমা রব্বিকাল আলা সূরাটি পড়ছিলে? এক ব্যক্তি বলল, আমি। আর এর দ্বারা মঙ্গল লাভ ছাড়া আমার ভিন্ন কোন উদ্দেশ্য ছিল না। নবীজী বললেন, আমার মনে হলো, তোমরা কেউ এ নিয়ে আমার পাঠে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছো। (সহীহ মুসলিম হাদীস নং ৩৯৮ সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ৮২৮ হাদীসের মান: সহীহ)
قَالَ سَمِعْتُ أَبَا هُرَيْرَةَ، يَقُولُ صَلَّى النَّبِيُّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ بِأَصْحَابِهِ صَلاَةً نَظُنُّ أَنَّهَا الصُّبْحُ فَقَالَ ” هَلْ قَرَأَ مِنْكُمْ مِنْ أَحَدٍ ” . قَالَ رَجُلٌ أَنَا . قَالَ ” إِنِّي أَقُولُ مَا لِي أُنَازَعُ الْقُرْآنَ
৮.অর্থ: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা নবী (ﷺ) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে নামায আদায় করেন। আমাদের মতে তা ছিল ফজরের নামায। নামায শেষে তিনি বলেনঃ তোমাদের কেউ কি কিরাত পড়েছে ? এক ব্যক্তি বললো, আমি পড়েছি। তিনি বলেনঃ তাই তো (মনে মনে) বলছিলাম আমার কুরআন পাঠে বিঘ্ন ঘটছে কেন! (সুনানে ইবনে মাজাহ হাদীস নং ৮৪৮ হাদীসের মান: সহীহ)
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم الإِمَامُ ضَامِنٌ وَالْمُؤَذِّنُ مُؤْتَمَنٌ اللَّهُمَّ أَرْشِدِ الأَئِمَّةَ وَاغْفِرْ لِلْمُؤَذِّنِينَ
৯.অর্থ: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূল (ﷺ) বলেছেন,ইমাম হল (মুসল্লীদের নামাযের) যিম্মাদার আর মুয়াযযিন হল (ওয়াক্তের) আমানতদার। হে আল্লাহ ইমামকে সঠিক পথ প্রদর্শন করুন আর মুয়াযযিনকে মাফ করুন। (সুনানে তিরমিযী হাদীস নং ২০৭ সুনানে আবু দাউদ হাদীস
নং ৫১৭ হাদীসের মান: সহীহ)
ব্যাখ্যা: উক্ত হাদীসে ইমামকে মুসল্লীদের নামাযের যিম্মাদার বলা হয়েছে এই জন্যই ইমামের নামায অশুদ্ধ হলে মুক্তাদীদের নামায অশুদ্ধ হয়ে যায়।ঠিক একইভাবে ইমাম কিরাত পড়লে মুক্তাদীদের কিরাত আদায় হয়ে যায়। তাই মুক্তাদীরা ইমামের পিছনে কোন কিরাত পড়বে না।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم إِذَا جِئْتُمْ إِلَى الصَّلاَةِ وَنَحْنُ سُجُودٌ فَاسْجُدُوا وَلاَ تَعُدُّوهَا شَيْئًا وَمَنْ أَدْرَكَ الرَّكْعَةَ فَقَدْ أَدْرَكَ الصَّلاَةَ ”
১০.অর্থ: আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা যখন নামাযে এসে আমাদের সিজদারত অবস্থায় পাবে, তখন তোমরা সিজদায় শামিল হয়ে যাবে। তবে উক্ত সিজদা নামাযের রাকাত হিসাবে গণ্য করবে না। যে ব্যক্তি রুকু পেয়েছে, সে নামাযও পেয়েছে (অর্থাৎ
ঐ রাকাত পেয়েছে)। (সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ৮৯৩ মিশকাতুল মাসাবীহ হাদীস নং ১১৪৩ হাদীসের মান: হাসান)
عَنْ أَبِي بَكْرَةَ، أَنَّهُ انْتَهَى إِلَى النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم وَهْوَ رَاكِعٌ، فَرَكَعَ قَبْلَ أَنْ يَصِلَ إِلَى الصَّفِّ، فَذَكَرَ ذَلِكَ لِلنَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَقَالَ ” زَادَكَ اللَّهُ حِرْصًا
১১.অর্থ: আবু বাকরা (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি নবী (ﷺ) এর কাছে এমন অবস্থায় পৌঁছালেন, নবী (ﷺ) তখন রুকুতে ছিলেন। তখন কাতার পর্যন্ত পৌঁছার আগেই তিনি রুকুতে চলে যান। এ ঘটনা নবী (ﷺ) এর কাছে উল্লেখ করা হলে, তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা তোমার আগ্রহকে আরও বাড়িয়ে দিন। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭৮৩ হাদীসের মান: সহীহ)
ব্যাখ্যা: এ হাদীস দুটি থেকেও বুঝা যাচ্ছে মুক্তাদীর জন্য ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পাঠ করতে হবে না। কেননা রুকুতে শরীক হলে সূরা ফাতিহা পড়ার সময় কোথায় ?
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ: أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: «لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الكِتَابِ»
১২.অর্থ: উবাদা ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত যে, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি (একাকী) নামাযে সূরা ফাতিহা পড়ল না তার নামায হবে না। (সহীহ বুখারী হাদীস নং ৭৫৬ হাদীসের মান: সহীহ)
ব্যাখ্যা: যে সূরা ফাতিহা পড়ল না,তার নামায হবে না। এর অর্থ হলো যখন কেউ একাকী নামায আদায় করবে, তখন যদি সূরা ফাতিহা না পড়ে তাহলে তার নামায হবে না। কিন্তু জামাতের সাথে নামায আদায় করলে তখন ইমামের কিরাত মুক্তাদীর কিরাত হিসেবে সাব্যস্ত হবে। যার প্রমাণ নিচের হাদীস দ্বারাও বুঝা যায়। কারণ এই হাদীসে সূরা ফাতিহার সাথে অন্য সূরা না পড়লেও নামায হবে না বলা হয়েছে। অথচ কেউই ইমামের সাথে সূরা ফাতিহার পর অন্য সূরা পড়ে না।
عَنْ عُبَادَةَ بْنِ الصَّامِتِ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” لاَ صَلاَةَ لِمَنْ لَمْ يَقْرَأْ بِفَاتِحَةِ الْكِتَابِ فَصَاعِدًا ”
১৩.অর্থ: উবাদা ইবনে সামিত (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, যে ব্যক্তি সূরা ফাতিহা এর পর অধিক (অন্য সূরা) পড়ল না, তার নামায হয়নি। (সুনানে নাসাঈ হাদীস নং ৯১১ সুনানে আবু দাউদ হাদীস নং ৮২২ হাদীসের মান: সহীহ)
মোটকথা ইমামের পিছনে মুক্তাদীগণ কোন কিরাত পড়বে না বরং চুপ থাকবে। তবে একাকী নামায আদায়কালে অবশ্যই সূরা ফাতিহা ও অন্য কিরাত পড়তে হবে নতুবা নামায আদায় হবে না।
وَاللّٰهُ أعْلَمُ باِلصَّوَاب
উত্তর প্রদানে- মুহাম্মদ রুহুল আমীন।
শিক্ষার্থী: মানহাল ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার।
উত্তর নিরীক্ষণে: শাইখ রায়হান জামিল।
পরিচালক: মানহাল ইসলামিক রিসার্চ সেন্টার।
Leave a Reply