আরবী খুতবা বনাম মাতৃভাষায় খুতবা

ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিছু ভাইয়েরা প্রচার করছে, জুম’আর খুতবা আরবীতে না দিয়ে মাতৃভাষায় দিতে হবে। তারা এরপক্ষে দলিল হিসেবে কিছু যুক্তি তুলে ধরছেন। তাদের এই যুক্তি যে কুরআন হাদীস ও যুক্তির আলোকেও সঠিক নয় তা নিচে উল্লেখ করা হলো।

১.তারা বলেন আরবীতে খুতবা দিলে মানুষ বুঝে না তাই বাংলাতে দিতে হবে। কিন্তু তারাই বিয়ের খুতবা, সালাতুল ইস্তিসকার খুতবা সম্পূর্ণ আরবীতে দিচ্ছেন। এমনকি জুম’আ ও ঈদের খুতবায় আল্লাহু আকবারসহ তাহমীদ, তাসমিয়াহ ও ছানা বাংলায় না বলে আরবীতে বলেন। অথচ এগুলোও তো সাধারণ মানুষ বুঝে না তাহলে কি তাদের দাবি অনুযায়ী খুতবা যথার্থ হলো ?

২. তারা বলেন বাংলায় নামায, রোযা, বেহেশত, দোযখ, খোদা ইত্যাদি শব্দ না বলে আরবীতে সালাত, সিয়াম, জান্নাত, জাহান্নাম ও আল্লাহ বলতে হবে। কিন্তু তাড়াই আবার বলে বেড়ায় খুতবা আরবীতে দেওয়া যাবে না বরং মাতৃভাষায় তথা বাংলাতে দিতে হবে। অথচ নামায, রোযা, বেহেশত, দোযখ ইত্যাদি শব্দগুলো আরবীতে বলা জরুরী নয়। কিন্তু খুতবা আরবীতে দেওয়া জরুরী যেমন: আযান, ইকামত, কুরআন তিলাওয়াত, যিকির ইত্যাদি আরবীতে বলা জরুরী। কারণ এগুলো ইসলামের প্রতিক। এ ছাড়াও তারা যে, নিজেদের নামে ওমুক বিন তমুক রাখেন এখানে বলা উচিত ছিল ওমুক ছেলে তমুক, কেননা সাধারন মানুষ তো এই বিন এর অর্থ বুঝে না। আর শায়েখ না বলে বলা উচিত ছিল বুড়া বা পণ্ডিত।

৩.খুতবা না বুঝার জন্য যদি নিজ ভাষায় খুতবা জায়েয হয় ? তাহলে যারা কুরআন পড়তেই জানেনা বা বাংলা অর্থ বুঝে না, তারা কি বাংলায় নামায পড়লে হবে ?

৪.খুতবা অর্থ ভাষণ হওয়ার কারণে যদি বলেন বাংলাতে খুতবা দেওয়া জায়েয। তাহলে একই যুক্তিতে আযান অর্থ ঘোষণা হওয়ার কারণে কি বাংলাতে আযান দেওয়া জায়েয হয়ে যাবে ?

৫. আমাদের দেশে জুম’আর নামাযে আরবী খুতবার আগে বাংলায় বয়ান করা হয়। সেটা রাসূল (ﷺ) করেননি কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম করেছেন। এরপরেও আপনারা জুম’আর আগে বাংলা বয়ানকে বিদ’আত বলেন। তাহলে একই যুক্তিতে আপনাদের জুম’আর পরের বাংলা প্রশ্নোত্তর করাও তো বিদ’আত হওয়ার কথা। কারণ উভয়টির কোনটিই তো রাসূল (ﷺ) করেননি। কিন্তু এই বিদ’আত নিয়ে আপনারা কথা বলেন না কেন ?

৬. যদি কোনো একটি মসজিদে জুম’আর খুতবার সময় কিছু ইংরেজি ভাষী, কিছু চীনা ভাষী, কিছু উর্দূ ভাষী, কিছু আরবী ভাষী ও কিছু বাংলা ভাষী মুসল্লী উপস্থিত থাকে। এমতাবস্থায় খতীব সাহেব শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে কাদের মাতৃভাষায় খুতবা পেশ করবেন ?

৭.সাহাবায়ে কেরাম বিভিন্ন অনারব দেশে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে গিয়েছেন। সেসব দেশে ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন। কিন্তু অনারবী রাষ্ট্রে এসে আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দেননি বরং আরবীতে শুধু খুতবা দিয়েছেন। এর সাথে সাথে তারা অনারবদের আরবী বানিয়েছেন। এ জন্যই বর্তমান পৃথিবীতে ২৫টি দেশের রাষ্ট্রভাষা আরবী দেখতে পাই। আর আমাদের কিছু ভাইয়েরা সেগুলো না করে মাতৃভাষায় খুতবা দেওয়ার দাবি করছেন। এতে কি ইসলামের প্রতীককে পাল্টে ফেলার ষড়যন্ত্রের অংশীদার হচ্ছেন না ?

৮.সাহাবায়ে কেরাম আরবী ভাষায় নয় বরং মাতৃভাষায় আযান দিয়েছেন, এমন কুযুক্তিতে আযান যেমন মাতৃভাষায় দেওয়া বিদ’আত। তেমনি রাসূল (ﷺ) আরবী ভাষায় নয় বরং মাতৃভাষায় খুতবা দিয়েছেন, এমন কুযুক্তিতে জুম’আর খুতবাও মাতৃভাষায় দেওয়া কি বিদ’আত নয় ?

৯. রাসূল (ﷺ) এর মৃত্যুর আগে অনেক অনারবী মানুষ মদীনায় জুম’আ পড়তে আসতেন তবুও তিনি অন্য ভাষায় খুতবা দেননি। এমনকি সাহাবায়ে কেরামও কোন দিন আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দিয়েছেন বলে কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। বরং সহীহ বুখারীর ৭১৯৫ নং হাদীসে পাওয়া যায়, আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) নিজের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য দোভাষী ব্যবহার করতেন। তবুও তিনি স্থানীয় ভাষায় খুতবা দেওয়া বা খুতবার অনুবাদের ব্যবস্থা করেননি। তাহলে এত বছর পরে মাতৃভাষায় খুতবা দেওয়া কি বিদ’আত নয় ?

১০. চার মাযহাবের ইমামের নিকটেই মাতৃভাষায় খুতবা দেওয়া নাজায়েয। কিন্তু কিছু ভাইয়েরা মাতৃভাষায় খুতবা দেওয়ার কোন দলিল না পেয়ে, মাযহাবের ইমামদের নামে অসত্য কথা প্রচার করছে। বিশেষ করে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর নামে। তিনি প্রথমদিকে মাকরূহে তাহরীমির সাথে জায়েয বলেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে তিনি এ মত প্রত্যাহার করেন দেখুন হেদায়া ১/১০২। সুতরাং চার মাযহাবের কোনো ইমামের নামে মাতৃভাষায় খুতবা জায়েয বলা কি অপবাদ নয় ?

-কুরআন ও সহীহ হাদীসের আলোকে পর্যালোচনা-

وَرَأَيْتَ النَّاسَ يَدْخُلُونَ فِي دِينِ اللَّهِ أَفْوَاجًا

১.অর্থ: আর আপনি দেখবেন মানুষেরা দলে দলে আল্লাহর দ্বীনে প্রবেশ করছে। (সূরা নাসর, আয়াত নং ২)

ব্যাখ্যা: উল্লেখিত আয়াত দ্বারা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে, রাসূল (ﷺ) এর পিছনে বিভিন্ন ভাষার মানুষ নামায আদায় করতো। তারপরও রাসূল (ﷺ) অন্য ভাষায় খুতবা দেওয়ার ব্যবস্থা করেননি। সুতরাং এখন আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় খুতবা দিলে বিদ’আত হবে।

يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا إِذَا نُودِيَ لِلصَّلَاةِ مِنْ يَوْمِ الْجُمُعَةِ فَاسْعَوْا إِلَى ذِكْرِ اللَّهِ

২.অর্থ: হে ঈমানদারগণ, যখন জুম’আর দিনে নামাযের জন্য আহ্বান করা হয়। তখন তোমরা আল্লাহর স্মরণের দিকে ধাবিত হও। (সূরা জুম’আ, আয়াত নং ৯)

ব্যাখ্যা: এই আয়াতের মধ্যকার যিকরুল্লাহ দ্বারা প্রায় সকল মুফাসসীরগণ লিখেছেন, এখানে ‘যিকির’ দ্বারা উদ্দেশ্য হলো ‘খুতবা’। (তাফসীরে রাযী ১/৪৪৬, তাফসীরে রুহুল মাআনী ২৮/১০২, তাফসীরে ইবনে আব্বাস রা.)

فَإِذَا خَرَجَ الإِمَامُ حَضَرَتِ المَلاَئِكَةُ يَسْتَمِعُونَ الذِّكْرَ

৩.অর্থ: যখন ইমাম খুতবা দেওয়ার জন্য বের হোন তখন ফেরেশতাগণ এসে যিকির শুনে অর্থাৎ খুতবা শোনে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৮৮১ সহীহ মুসলিম, হাদীস নং ৮৫০ হাদীসের মান: সহীহ)

ব্যাখ্যা: উক্ত আয়াত ও হাদীসে খুতবাকে যিকির বলা হয়েছে। সুতরাং কুরআন তিলাওয়াত ও যিকির যেমন অন্য ভাষায় করা যায় না। তেমনি খুতবাও যিকির হওয়ার কারণে আরবী ছাড়া অন্য ভাষায় দেওয়ার সুযোগ নেই।

عن عُمَرَ إنَّمَا قَصُرَتْ الصَّلَاةُ لِأَجْلِ الْخُطْبَةِ

৪. অর্থ: ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত: জুম’আর নামাযকে খুতবার জন্য ছোট করে দেওয়া হয়েছে। (ইবনে হাজার আসকালানী আত-তালখীসুল হাবীর ২/৫৯৫ হাদীসের সনদ: মুরসাল)

তাহকীক: আল্লামা উসমানী (রহ.) বলেন, ইবনে হাজম এটাকে মুরসাল বলেছেন। আর প্রথম তিন যুগের মুরসাল আমাদের কাছে গ্ৰহণযোগ্য। (ইলাউস সুনান ৮/৬৬)

ব্যাখ্যা: খুতবা নিছক বক্তৃতার নাম নয়, এটি নামাযের মতই গুরুত্বপূর্ণ এবং দুই রাকাত নামাযের স্থলাভিষিক্ত। তাই নামায যেমন আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় পড়া যায় না। তেমনি খুতবাও অন্য ভাষায় পড়া যাবে না।

مَنْ يَعِشْ مِنْكُمْ بَعْدِي فَسَيَرَى اخْتِلاَفًا كَثِيرًا فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الْمَهْدِيِّينَ الرَّاشِدِينَ تَمَسَّكُوا بِهَا وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ وَإِيَّاكُمْ وَمُحْدَثَاتِ الأُمُورِ فَإِنَّ كُلَّ مُحْدَثَةٍ بِدْعَةٌ وَكُلَّ بِدْعَةٍ ضَلاَلَةٌ ” .

৫.অর্থ: রসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেছেন, তোমাদের মাঝে যারা আমার পরে জীবিত থাকবে, তারা বহু মতভেদ দেখতে পাবে। তখন তোমাদের উচিত হবে আমার ও আমার খুলাফায়ে-রাশেদার সুন্নতের অনুসরণ করা, যারা সত্য ও ন্যায়ের অনুসারী। তোমরা তাদের দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করবে। আর সাবধান থাকবে, নব উদ্ভাবিত ধর্মীয় বিষয় থেকে। কেননা ধর্ম বিষয়ে প্রতিটি নতুন বিষয়ই বিদ’আত। আর প্রতিটি বিদ’আতই গোমরাহী। (সুনানে আবু দাউদ, হাদীস নং ৪৬০৭ সুনানে তিরমিযী, হাদীস নং ২৬৭৬ হাদীসের মান: সহীহ)

মোটকথা আরবী ছাড়া অন্য যে কোনো ভাষায় খুতবা দেওয়া বিদ’আত ও নাজায়েয। কারণ তা রাসূল (ﷺ) সাহাবায়ে কেরাম, তাবেঈ, তাবে-তাবেঈ এবং গোটা মুসলিম জাতির সর্বযুগে সর্বসম্মত আমলের পরিপন্থী।

Share This Post

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *